পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে: সহজ নির্দেশিকা এবং প্রয়োজনীয় নথি
পাসপোর্ট হল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি, যা আন্তর্জাতিকভাবে যাতায়াতের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট চালু হওয়ার ফলে পাসপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়া আরও আধুনিক ও সহজ হয়েছে। তবে, পাসপোর্ট করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট নথি এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়োজন। অনেক সময় সঠিক নথি বা প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে পাসপোর্ট তৈরি করতে বিলম্ব হতে পারে। তাই, পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে সেই প্রশ্নের উত্তর জানা অত্যন্ত জরুরি।
এই নিবন্ধে আমরা পাসপোর্ট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় নথি, অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া, ছবি জমা দেওয়ার নিয়ম এবং ফি প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। সঠিক তথ্য ও নির্দেশনা মেনে চললে আপনি খুব সহজেই আপনার পাসপোর্ট পেতে পারেন।
১. জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) বা জন্ম নিবন্ধন সনদ
পাসপোর্ট তৈরি করতে প্রথম যে নথিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)। এটি আপনার নাগরিকত্ব এবং পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যদি আপনার বয়স ১৮ বছরের বেশি হয়, তাহলে পাসপোর্টের জন্য NID অবশ্যই প্রয়োজন হবে। NID এর মাধ্যমে আপনার সমস্ত তথ্য যাচাই করা হয়, যা পাসপোর্ট অফিস এবং ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। যাদের NID নেই, তাদের ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদ জমা দেওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে ১৮ বছরের নিচে যারা, তাদের জন্য জন্ম সনদই প্রধান পরিচয়পত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, বিদেশে পাসপোর্ট করার সময় জন্ম সনদ অবশ্যই ইংরেজি সংস্করণে থাকতে হবে।
এছাড়াও, পাসপোর্ট তৈরি করতে গেলে আপনি যদি কোন পরিবর্তিত তথ্য ব্যবহার করেন, যেমন নাম বা ঠিকানার ক্ষেত্রে কোনো সংশোধন বা পরিবর্তন হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সংশোধিত NID বা সংশ্লিষ্ট প্রমাণপত্র জমা দেওয়া প্রয়োজন। এই নথিগুলোর সঠিকতা নিশ্চিত করার পরেই পাসপোর্ট তৈরি হয়। সুতরাং, আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম সনদ সঠিক ও হালনাগাদ আছে কিনা, তা অবশ্যই যাচাই করা উচিত।
২. পাসপোর্ট ফি পরিশোধের চালান
পাসপোর্ট তৈরির জন্য পাসপোর্ট ফি পরিশোধ করতে হয়, যা পাসপোর্ট প্রক্রিয়ার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ফি প্রদানের জন্য আপনাকে ব্যাংকের মাধ্যমে চালান জমা দিতে হবে। এই ফি নির্ধারিত হয় পাসপোর্টের ধরন এবং আপনার প্রয়োজনীয় সময় অনুযায়ী। সাধারণত, পাসপোর্টের জন্য তিন ধরণের ফি রয়েছে: সাধারণ, জরুরি এবং অতি জরুরি।
- সাধারণ ফি: যারা তাড়াহুড়ো না করে পাসপোর্ট তৈরি করতে চান, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত। সাধারণত ১৫-২০ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট প্রদান করা হয়।
- জরুরি ফি: যদি আপনি তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট পেতে চান, তবে আপনি জরুরি ফি পরিশোধ করতে পারেন, যেখানে ৭-১০ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট প্রদান করা হয়।
- অতি জরুরি ফি: যদি আপনার খুব অল্প সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট প্রয়োজন হয়, তবে অতি জরুরি ফি দিয়ে মাত্র ২-৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট তৈরি করা সম্ভব।
চালান জমা দেওয়ার পর অবশ্যই চালানের কপি আবেদনপত্রের সাথে যুক্ত করতে হবে। ফি প্রদানের পর সেটি অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করা হয়। এই ফি পরিশোধের মাধ্যমেও আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে আপনি সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় চালান জমা দিয়েছেন। পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে এই প্রসঙ্গে ফি প্রদান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কারণ এর ভিত্তিতেই আপনার পাসপোর্ট প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং সময়মতো শেষ হয়।
৩. অনলাইন আবেদন সারাংশ (Application Summary)
ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে গেলে আপনাকে অবশ্যই অনলাইনে আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে। এটি পুরো প্রক্রিয়াটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং এটি যথাযথভাবে পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি। পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে অনলাইন ফর্মের সঠিক পূরণ একটি অপরিহার্য বিষয়। ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে গেলে ই-পাসপোর্ট পোর্টালে গিয়ে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য এবং প্রয়োজনীয় নথির বিবরণ দিতে হবে।
ফর্ম পূরণের সময় কিছু বিশেষ তথ্য যেমন আপনার নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর (NID), পাসপোর্ট ফি পরিশোধের তথ্য এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য সঠিকভাবে দিতে হবে। আবেদন ফর্ম জমা দেওয়ার পর আপনি একটি সারাংশ পাবেন, যাকে বলে আবেদন সারাংশ বা Application Summary। এই সারাংশটি প্রিন্ট করে পাসপোর্ট আবেদন জমা দেওয়ার সময় সাথে রাখতে হবে।
এই সারাংশে আপনার সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য উল্লেখ থাকবে, যা পাসপোর্ট প্রক্রিয়ার সময় কাজে লাগবে। সারাংশে কোন ভুল বা অসঙ্গতি থাকলে সেটি অবশ্যই সংশোধন করতে হবে, কারণ আপনার পাসপোর্ট তৈরির সময় এই তথ্যই প্রধান বিবেচ্য হবে।
অনলাইন আবেদন ফর্ম জমা দেওয়ার পর, আপনাকে নির্দিষ্ট সময়ে পাসপোর্ট অফিস বা ই-পাসপোর্ট সেন্টারে গিয়ে আপনার বায়োমেট্রিক তথ্য (আঙুলের ছাপ, ছবি, এবং স্বাক্ষর) জমা দিতে হবে। এর মাধ্যমে পাসপোর্টের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং পাসপোর্ট তৈরির কাজ শুরু হয়।
৪. ছবি জমা দেওয়া
পাসপোর্টের জন্য সঠিক ছবি জমা দেওয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে সেই প্রশ্নের উত্তরে, একটি উপযুক্ত ছবি প্রয়োজনীয় নথির মধ্যে অন্যতম। পাসপোর্টের জন্য নির্ধারিত মাপের ছবি জমা দিতে হয়, যা সাধারণত ৩R সাইজের হয় এবং ফর্মাল পাসপোর্ট ছবির নিয়মাবলী মেনে তোলা হয়।
ছবির ক্ষেত্রে কিছু নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে। প্রথমত, ছবিটি সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে হতে হবে এবং মুখের সমস্ত অংশ পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান থাকতে হবে। ছবি তোলার সময় আপনার মুখের অভিব্যক্তি নিরপেক্ষ হতে হবে, মানে কোনও হাসি বা বিশেষ ভঙ্গিমা থাকলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। চোখ সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে এবং মাথা সোজা অবস্থায় থাকতে হবে।
অনলাইনে ছবি আপলোড করার সুযোগও রয়েছে। অনলাইনে ছবি জমা দেওয়ার সময় অবশ্যই ছবির রেজোলিউশন এবং সাইজ সম্পর্কে নির্ধারিত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে, যাতে ছবি সঠিকভাবে আপলোড হয় এবং তা প্রক্রিয়াকরণে কোনও সমস্যা না হয়।
ছবির গুণমান ঠিক থাকলে তা পাসপোর্টে ব্যবহার করা হয়, যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিকভাবে পাসপোর্ট যাচাইয়ের সময়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাসপোর্ট ছবি তোলার সময় প্রয়োজনীয় নিয়মাবলী এবং নির্দেশনা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
৫. অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথি
পাসপোর্ট করতে গেলে শুধু NID বা জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং ফি প্রদানই নয়, আরও কিছু নথি প্রয়োজন হতে পারে, যা আপনার নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। বিশেষ করে আপনি যদি শিক্ষার্থী হন, সরকারি চাকরিজীবী হন বা বিবাহিত হন, তাহলে এই ধরনের প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য:
শিক্ষার্থীরা পাসপোর্ট করতে গেলে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্ট আইডি কার্ড অথবা প্রতিষ্ঠানের সনদপত্র জমা দিতে হবে। এই নথিগুলোর মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ছাত্রী।
বিবাহিত ব্যক্তিদের জন্য:
আপনি যদি বিবাহিত হন, তাহলে আপনার বিবাহের প্রমাণ হিসেবে নিকাহনামা জমা দিতে হবে। বিশেষ করে যদি আপনার নাম পরিবর্তন করা হয়ে থাকে, তাহলে নতুন নামের প্রমাণপত্রসহ নিকাহনামা জমা দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য:
যদি আপনি সরকারি চাকরিজীবী হন, তাহলে আপনাকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (NOC) জমা দিতে হবে, যা আপনার কর্মস্থল থেকে প্রদান করা হয়। এই সার্টিফিকেটের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে আপনার পাসপোর্ট তৈরিতে কোনো বাধা নেই এবং আপনি বৈধভাবে বিদেশে যাতায়াত করতে পারবেন। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি হলো সরকারী আদেশ (GO), যা কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে।
এছাড়াও, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে আপনি যদি নাম পরিবর্তন করে থাকেন বা কোনোরকম আইনগত সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তাহলে সংশোধনের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
১. পাসপোর্ট করতে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কি করা যাবে?
হ্যাঁ, ১৮ বছরের নিচে যাদের NID নেই, তাদের ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদ জমা দিতে হয়। তবে, বিদেশে পাসপোর্ট করতে গেলে সনদটি ইংরেজি সংস্করণে থাকতে হবে।
২. কত দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়া যায়?
পাসপোর্টের ধরন অনুযায়ী সময় ভিন্ন হয়। সাধারণ পাসপোর্ট ১৫-২০ দিনের মধ্যে, জরুরি পাসপোর্ট ৭-১০ দিনের মধ্যে এবং অতি জরুরি পাসপোর্ট ২-৫ দিনের মধ্যে পাওয়া যায়।
৩. ই-পাসপোর্টের সুবিধা কী?
ই-পাসপোর্টে উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং দ্রুত ইমিগ্রেশন সুবিধা রয়েছে। এটি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ই-পাসপোর্ট ব্যবহারকারীরা ই-গেটের মাধ্যমে দ্রুত ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন।
উপসংহার
পাসপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করলে এটি সহজ এবং দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব। পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে সেই প্রশ্নের উত্তরে আমরা জানতে পেরেছি যে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন সনদ, ফি পরিশোধের চালান, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথি থাকা অত্যন্ত জরুরি। সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় নথি প্রস্তুত রাখলে এবং অনলাইনে আবেদন করলে, আপনার পাসপোর্ট দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে তৈরি হবে।